আইনে গলদ
সারদা কেলেঙ্কারিতে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ধাপে ধাপে আইন ভেঙে চলেছে রাজ্য সরকার। নিয়মবর্হিভূতভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিল তৈরি হয়েছে। লগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি কার্যকলাপ মোকাবিলায় প্রস্তাবিত নতুন আইনে অনেক ভুল ধরা পড়েছে। ফলে সেই প্রস্তাবিত আইন ফেরত পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিলটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য। চিট ফান্ডের বিকল্প হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষিত রাজ্য সরকারের এই নিজস্ব সঞ্চয় প্রকল্প এখনও আইনি অনুমোদন পায়নি। এই প্রকল্প চালুর সম্ভাব্য তারিখ ছিল ৫ই অক্টোবর। সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র এখনও মেলেনি। অনুমোদন পাওয়ার পর কবে এই প্রকল্প চালু হবে তা এখনও অনিশ্চিত। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, সরকারের উদ্যোগে এই প্রকল্প ‘সুরক্ষিত’ হবে। জাতীয় ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের তুলনায় এই প্রকল্পে ১ শতাংশ বেশি সুদ পাওয়া যাবে। যদিও তা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দেওয়া সুদের হারের সমান। রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের জন্য ৩০ হাজার এজেন্টও নির্দিষ্ট করেছে বলে জানিয়েছে। এই এজেন্টরা ডাকঘরের এজেন্টদের থেকে বেশি হারে কমিশন পাবে। সরাসরি রাজ্য সরকার নয়, ডবলিউ বি আই ডি এফ সি এই আমানত সংগ্রহ করবে। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোনও প্রাক্ অনুমোদন নেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর চমক দেওয়া ঘোষণার পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অনুমোদনের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। আমানত সংগ্রহকারী সরকারী সংস্থাটির এ ব্যাপারে এক্তিয়ার, পরিকাঠামো আছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে আর বি আই। এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখার পরই অনুমোদন মিলতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের হারে সুদ মিললে সাধারণ মানুষ কেন আলাদা করে এই প্রকল্পে অর্থ জমা রাখবেন? রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, দুর্বলতর অংশের মানুষের জন্য এই প্রকল্প করা হয়েছে। যেসব জায়গায় অর্থাৎ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা নেই সেখানে এই প্রকল্প কিভাবে চালু হবে?
এই প্রকল্প ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সারদা কেলেঙ্কারি থেকে শাসকদলকে আড়াল করার চেষ্টা। সারদা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সারদার ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের সাহায্য করার জন্য তামাকজাত দ্রব্য থেকে অতিরিক্ত কর ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু লাক্সারি ট্যাক্সের ঊর্ধ্বসীমা না বাড়িয়েই এই তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সম্ভবত নিয়মে আটকে এখনও এই তহবিল গঠন সম্ভব হয়নি। সারদার আমানতকারীদের কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ মিলেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে। যদিও সরকারী কোষাগার থেকে একটি বেসরকারী চিট ফান্ডে প্রতারিতদের অর্থ দেওয়া সরকারী নিয়মের পরিপন্থী। সারদার পাশাপাশি আরো অনেকগুলি চিট ফান্ড সংস্থা এ রাজ্যের মানুষকে প্রতারণা করেছে। ঐসব সংস্থার প্রতারিত মানুষই বা তাহলে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবেন না কেন? লগ্নি সংস্থায় আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকার যে বিল এনেছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। ফলে কোন আইনবলে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। সারদা কেলেঙ্কারির ও শাসকদলের যোগসাজশ বিভিন্নভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বারেবারে দাবি ওঠা সত্ত্বেও এই ধরনের একটি আর্থিক অপরাধ তদন্ত করার দায়িত্ব সি বি আইকে দেওয়া হয়নি। আসল অপরাধীরা যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য নিয়মকানুন, তদন্ত, ক্ষতিপূরণ, সরকারী সঞ্চয় প্রকল্প সবকিছুরই মধ্যে গলদ থেকে যাচ্ছে। এইসব গলদের উদ্দেশ্য একটাই—চমক দিয়ে আসল অপরাধীদের আড়াল করা।
- See more at: http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=47179#sthash.XjaCGZMd.dpuf
No comments:
Post a Comment